বুধবার, ৩০ জুলাই, ২০১৪

সার্ভাইভ জানুন- ৪

আগুনঃ মানব সভ্যতার ইতিহাসের সবচাইতে বড় প্রেক্ষাপট ছিলো আগুন আবিষ্কার। আগুনের আবিষ্কার মানুষের জীবনে অনেক প্রভাব বিস্তার করে। তাই আজ যদি আগুন আবিষ্কার না হত তবে আমাদের মানব সভ্যতা হয়তো এখনো সেই আদিম অবস্থাতেই থাকতো।আগুনের আলো দূর করেছে রাতের ঘন অন্ধকার, দূরে সরিয়ে রেখেছে হিংস্র জন্তুদের। তাছাড়া কাঁচা খাবার কে আগুনে পুরিয়ে বা রান্না করে খেতে শিখেছি আমরা আগুনের কারনেই। যাইহোক, সারা পৃথিবীতে আগুন জ্বালানোকে সার্ভাইভালের সর্ব প্রধান কাজ হিসাবে গন্য করা হয়। কারন আগুন না থাকলে সার্ভাইভ করাটা নিতান্তই খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আপনি যেখানেই কেম্প করুন না কেন আগুন না থাকলে আপনাকে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। আপনাকে কাঁচা খাবার খেতে হবে। আপনি খাওয়ার জন্য পানি ফুটাতে পারবেন না। তাছারা আগুন জ্বালাতে না পারলে রাতে আপনাকে অন্ধকারে থাকতে হবে যার ফলে আপনি হিংস্র জন্তুর দ্বারা আক্রান্ত হতে পারেন। তাছারা আপনি যেখানেই থাকুন আর যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন আগুন আপনাকে সবসময় সাহস যোগাবে দুরন্ত প্রকৃতিতে টিকে থাকতে। তবে এখন আগুন জ্বালানোটা অনেক সহজ হয়েগেছে। আগুন জ্বালানো জন্য এখন আমাদের আর পাথরে ঠুকাঠুকি করতে হয়না। আজকাল বাজারে আগুন ঝ্বালানোর জন্য এমন জিনিস পাওয়া যায় যা পানিতে ভিজলেও কাজ করে। এগুলোর কয়েকটা আমি ছবি সমেত বর্ননা দিতে চেষ্টা করছি । আশা করি এগুলো আপনাদের ব্যবহারিক জীবনে কাজে আসবে।
দেয়াশলাইঃ
এটি আমাদের সকলেরই খুব চেনা একটি বস্তু। প্রতিদিনই এটি ব্যবহার করে থাকি আমরা। দেয়াশলাই বা মেছকাঠি দিয়ে আমরা খুব সহজেই আগুন জ্বালতে পারি। তবে কেম্পিং এর জন্য আজকাল বিষেশ এক ধরনের দেয়াশলাই পাওয়া যায় যেগুলো পানিতে ভিজলে অথবা অতিরিক্ত ঠান্ডায় এর বিষেশ কোন ক্ষতি হয় না।
ফয়ার স্টারটারঃ
এটি একটি অত্যাশ্চার্য বস্তু যা দিয়ে খুব সহজেই যে কোন পরিবেশে যে কোন অবস্থায়আগুন জ্বালানো যায়।ফায়ার স্টারটার এর সাথে একটি স্টিলের পাত থাকে এটিকে স্ক্রেচার বলে। এই স্ক্রেচার দিয়ে ফায়ার স্টারটার এ ঘসলে আগুনের ফুলকি তৈরী করে যা থেকে আগুন জ্বালানো সম্ভব হয়। আগুনের ফুলকি শুনে হতাস হবেন না
কারন এটি লাইটারের পাথরের ফুলকির মত নয়। ফায়ার স্টারটার এ উৎপন্য প্রতিটা ফুলকির তাপমাত্রা প্রায় তিনহাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস সুতরাং আর একবার ভাবুন। ফায়ার স্টারটার পানিতে ভিজলেও সমস্যা হয় না আর আকারে ছোট বলে খুব সহজেই বহন করা যায়। আপনি চাইলে ফায়ার স্টারটারকে লকেটের মত গলায়ও ঝুলিয়ে রাখতে পারেন।
ম্যাগনেশিয়াম বারঃ

ম্যাগনেশিয়াম বারও অনেকটা ফায়ার স্টারটারের মত কাজ করে তবে এটি আকারে আর একটু বড়, কাজের পদ্ধতিও একটু ভিন্ন। এটা দিয়ে আগুন জ্বালাতে গেলে প্রথমে আপনাকে একটি স্ক্রেচার দিয়ে বার থেকে ম্যাগনেশিয়াম গুঁড়ো জ্বালানীর উপর রাখতে হবে এবং অন্য একটি স্ক্রেচার দিয়ে বারের আরেক প্রান্তে বসানো চিকন একটি লোহার পাতে ঘসে আগুনের ফুলকি তৈরী করে সেই ম্যাগনেশিয়াম গুড়োতে আগুন লাগাতে হবে। কাজটা ফায়ার স্টারটার
এর তুলনায় একটু জটিল হলেও অনেকে এটা ব্যবহার করে থাকে কারন আমাদের সকলেরই জানা আছে যে ম্যাগনেশিয়াম খুবই দাহ্য পদার্থ। তবে এটা আসলে পছন্দের বেপার আপনি আপনার পছন্দ অনুযায়ী যে কোন একটা ব্যবহার করতে পারেন।
গ্লীসারিন ও পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট মিশ্রনঃ
গ্লিসারিন ও পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট এ দুইটি জিনিস আমাদের সবারই খুব পরিচিত। প্রায় সময়ই আমরা কাটা-ছরা ও পানি জীবাণু মুক্ত কাজে আরো পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট বা পটাশ আমরা ব্যবহার করে থাকি আর বিশেষ করে শীতে আমাদের ত্বককে কোমল রাখতে আমরা গ্লিসারিন ব্যবহার করি। কিন্তু এ দুটই হলো দাহ্য পদার্থ। আমরা যদি গ্লিসারিন ও পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট কে একত্রে মেশাই তবে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে আগুন তৈরী হবে। এর জন্য আপনাকে শুধু পদার্থ দুটি সমান সমান ভাবে মিশাতে হবে। এথেকে যে তাপ তৈরী হবে তাতে আপনি ভেজা বা সেঁত সেঁতে জ্বালানিতেও আগুন জ্বালতে পারবেন।

ফায়ার স্পিন্ডেলঃ

আদী যুগে এমনকি এখনও পৃথিবীর অনেক প্রত্যন্ত জায়গায় আদিবাসীরা এ পদ্ধতিতে আগুন জ্বালিয়ে থাকে। তবে এখন আর্মি, স্কাউট এবং সার্ভাইভাল এক্সপার্টরাও এ পদ্ধতিতে আগুন জ্বালিয়ে থাকেন। একটা কথা জানা প্রয়োজন যে এ উপায়ে আগুন জ্বালানোটা খুবই কঠিন কারন যেহেতু ঘর্সন প্রকৃয়ায় আগুন তৈরী হবে তার জন্য আপনাকে প্রচুর শক্তি ক্ষয় করতে হবে এবং দৃড় মানসিকতার অধিকারী হতে হবে। এটি হলো সর্বশেষ উপায়, যখন আগুন জ্বালানোর মত আপনার আর কিছু থাকবেনা। আপনাকে অনেক দিনের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে এর জন্য। যাই হোক, আপনাকে মনে রাখতে হবে যে এ উপায়ে শুধূ এক টুকরো জ্বলন্ত কয়লা তৈরী হবে তাই আপনাকে প্রথমেই কিছু তুলো অথবা নারকেলের ছোবড়া ছাড়িয়ে পাখির বাসার মত বানিয়ে নিতে হবে যাতে জ্বলন্ত কয়লা খুব সহজেই একটি বড় আগুন তৈরী করতে পারে। প্রথমেই আপনি একটি কাঠ নিন এবং এতে ছুরি দিয়ে একটি ছিদ্র করুন, এরপর আপনি একটি একহাত লম্বা সোজা ও মসৃন ডাল নিন। আপনি একটি ধনুক তৈরী করুন এবং কাঠিতে সংযোজন করুন।
কাঠের গর্তে সামান্য পরিমান কাঠের গুরো দিন ও ধনুক সমেত ডালটি গর্তে স্থাপন করুন। এবার ছোট আরেকটুরো কাঠ বা বোতলের ছিপি বা শক্ত কাপড় আপনার বাঁহাতে নিয়ে ডালটির অন্য প্রান্তে চেপে ধরুন এবং ডানহাত দিয়ে ধনুকটি ধরে সামনে-পেছনে ড্রিল মেশিনের মত চালনা করতে থাকুন। এতে একসময় ঘর্ষনের ফলে কাঠটি গরম হয়ে

প্রথমে ধোঁয়া এবং তার পর জ্বলন্ত কয়লা তৈরী হবে। তবে একটা বিষয়ে সাবধান থাকবেন আপনার কপাল বা নাক থেকে ঘাম যেন গড়িয়ে না পরে তাতে আপনার সমস্ত পরিশ্রম ব্যর্থ হতে পারে কারন আমি আগেই বলেছি যে কাজটি খুবই সময় সাপেক্ষ। তবে ফায়ার স্পিন্ডেলে আগুন জ্বালানোর জন্য আপনার মনোবল এবং শারীরিক শক্তি দুটোরি সমান প্রয়োজন কারন ফায়ার স্পিন্ডেল দিয়ে আগুন জ্বালাতে গেলে আপনাকে স্পিন্ডেল বা লম্বা ডালটি ততক্ষন ঘোরাতে হবে যতক্ষন না জ্বলন্ত কয়লা বের হয়। অনেকে আবার ফায়ার স্পিন্ডেলে ধনুক ব্যবহার না করে হাত দিয়ে ঘুরিয়েও আগুন তৈরী করে। কিন্তু আর জন্য আপনার হাতের তালা বা চেটো অসম্ভব রকম শক্ত হতে হবে তা না হলে ফোসকা পরে যাবে। তবে যাই হোক আপনি ফায়ার স্পিন্ডেল যে ভাবেই ব্যবহার করেন না কেন একটা কথা সবসময় মনে রাখবেন ফায়ার স্পিন্ডেলে আগুন জ্বলতে গেলে আপনাকে ইস্পাত কঠিন স্নায়ুর অধিকারী হতে হবে কারন ফায়ার স্পিন্ডেলে একটুকরো কয়লা তৈরী করতে গেলে কম করে হলেও দুই থেকে আড়াই ঘন্টা সময় লেগে যায় তবুও যদি আপনি একটানা না থেমে স্পিন্ডেল ঘরিয়ে যান। আপনি বারবার হেরে যাবেন ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে যাবেন তবুও আপনাকে চেষ্টা করে যেতেই হবে। বাসায় নিয়মিত চর্চা করলে এক সময় ব্যপার গুলো সহজ হয়ে যায়। আগুন সংক্রান্ত খুঁটিনাটিঃ
১. চারক্লোথঃ চারক্লোথ দিয়ে খুব সহজেই আগুন জ্বালানো যেতে পারে। এটি তৈরী করতে প্রথমে একটুকরো সুতির কাপড় ও একটি ছোট টিনের কৌটা নিন। টিনের কৌটায় ছোট একটু ছিদ্র করুন ও কৌটাতে কাপড়ের টুকরোটি ভরে মুখ বন্ধ করে কৌটাটি আগুনে দিন। কিছুক্ষন পর কৌটাটি গরম হয়ে ভেতরের কাপড় থেকে সমস্ত আদ্রতা বাস্পাকারে কৌটার ফুঁটো দিয়ে বেড় হয়ে আসবে। সমস্ত আদ্রতা বেড় হয়ে যাবার পড় কৌটাটি খুললে দেখা যাবে ভেতরের কাপড়টি কালো হয়ে গেছে। এটিই চারক্লোথ। চারক্লোথ খুবই দাহ্য পদার্থ তাই এটি সামান্য আগুনের ফুলকিতেও জ্বলে উঠে। তাই সাথে চারক্লোথ থাকলে তা দিয়ে সহজেই আপনি আগুন জ্বলতে পারবেন।
২. ফায়ার পিষ্টনঃ ফায়ার পিষ্টনে বাতাসের ঘর্ষন কে কাজে লাগিয়ে আগুন তৈরী করা হয়। এর জন্য আপনাকে দুই মাথা বন্ধ দুই টুকরো পাইপ সংগ্রহ করতে হবে। পাইপের টুকরো দুটি হতে হবে এন্টেনার মত যাতে একটি অপরটির মদ্ধে খুব সহজেই আশা যাওয়া করতে পারে। এবার আপনি পাইপের এক টুকরোর খোলা মুখে সামান্য কয়লা বা শুকনো কাঠের ছোট টুকরো ভরে দিয়ে পাইপের টুকরোটি অপর টুকরোর সাথে যুক্ত করে ইট বা পাথরের টুকরো দিয়ে জোড়ে কয়েকবার ঝটকা দিন। ঝটকার ফলে ফাইপ দুটো সাইকেলের পাম্পারের মত কাজ করবে এবং পাইপ দুটো দুই মাথা আটকানো থাকার ফলে ভেতরের বাতাস একমাথা থেকে অপর মাথায় ঘর্ষন জনিত কারনে গরম হয়ে ভেতরের জ্বালানীতে আগুন তৈরী করবে।
৩. মোবাইলের ব্যাটারীর সাহায্যেঃ আপনার সাথে যদি মোবাইল থাকে তবে তা দিয়েও আগুন জ্বালানো যেতে পারে। এখনকার মোবাইলের ব্যাটারী গুলোর মধ্য একপ্রকারের এসিড থাকে। আপনি একটি ছুড়ি নিন ও বেটারীটি একটু ফুটো করুন। এবার ছুড়ি দিয়ে বেটারীর (+/-) কে এক করে স্পার্ক তৈরী করুন দেখবেন স্পার্ক টি লিকুইডে লেগে আগুন তৈরী করবে। আপনি একই ভাবে (+/-) ব্যবহার করে গাড়ীর বেটারী থেকেও আগুন জ্বালতে পারবেন।
৪. ক্যামেরার লেন্স অথবা আতস কাঁচ ব্যবহার করেঃ ক্যামেরার লেন্স অথবা আতস কাঁচ ব্যবহার করে সূর্যের আলোকে ব্যবহার করেও আগুন জ্বালতে পারবেন।
৫.পেট্রোলিয়াম জেলীঃ শরীর কে কোমল রাখার জন্য আমরা যে পেট্রোলিয়াম জেলী ব্যবহার করি তা ও এক ধরনের দাহ্য পদার্থ। এটিকে তুলোয় বা কাপড়ে মাখিয়ে নিলে ভাল একটি জ্বালানির উৎস পাওয়া যায়। কারন এ দিয়ে চট্ করে আগুন জ্বালানো যায়।
সতর্কতাঃ আপনি যা দিয়েই আগুন জ্বালান না কেন আপনাকে প্রথমেই ভালো জ্বালানী সংগ্রহ করতে হবে ও তা হাতের কাছে রাখতে হবে কারন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আপনি সামান্য জ্বলন্ত কয়লা তৈরী করবেন যা থেকে পরে আপনাকে বড় আগুন তৈরী করতে হবে।তাই জ্বালানী ভালো ভাবে তৈরী করে না রাখলে আপনার সমস্ত পরিশ্রম নষ্ট হতে পারে।
আপনাকে এমন জ্বালানী সংগ্রহ করতে হবে যেটা সামান্য জ্বলন্ত কয়লাতেও খুব সহজেই জ্বলে উঠে। যেমন, নারকেলের ছোবড়া, দড়ি কিংবা পাখির বাসা দিয়ে আগুন জ্বালাতে চান তবে প্রথমেই এ গুলোকে দুহাতে জোড় ঘসে নরম ও ঝুরঝুরে করে নিতে হবে এর ফলে আপনি যখন এতে কয়লার জ্বলন্ত টুকরো দিবেন তখন সেটি জ্বলানীতে রেখে সামান্য ফুঁ দিলে তা সহজেই জ্বলে উঠবে।
(চলবে)

 
 
 

 
 

1 টি মন্তব্য:

  1. ফায়ার স্টারটার চট্টগ্রাম এর কোথায় পাওয়া যাবে আর এর দাম কি রকম হবে?

    উত্তরমুছুন